বহু দিনের সম্পর্ক আর রাখতে চাইছিল না ছাত্রীটি। তার জেরেই হস্টেলে ঢুকে তাকে খুন করে তার প্রেমিক। এখানেই শেষ হতে পারত গল্পটা। কিন্তু বাধ সাধল তার ফোনে আসা একটা মেসেজ। টিং-টাং আওয়াজ করে মোবাইলে ঢুকল একটা মেসেজ। এই মোবাইলটা তার, যার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ কিছুক্ষণ আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে লাশকাটা ঘরে। তদন্তকারী পুলিশ অফিসার মোবাইলের অপেক্ষাকৃত সহজ লক খুলে ফেলেছিলেন খানিক আগে। স্ক্রিনে চোখ রেখে তিনি দেখতে পেলেন সেই মেসেজটা। যেখানে লেখা রয়েছে, ‘শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি। ফের যদি একই কথা বলতে হয়, তবে তা যে ভালো হবে না সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’ কে পাঠাল এরকম হুমকি বার্তা? পুলিশ অফিসারের সতর্ক দৃষ্টি ততক্ষণে আটকে গিয়েছে এসএমএসের নীচে ক্যাপিটাল লেটারে লেখা AK-তে। পুলিশের কাছে আসলে এই তদন্তটা ছিল অনেকটাই সহজ একটা ধাঁধা, যার সোজা উত্তর- প্রেমে প্রত্যাখ্যাত এক যুবকের প্রেমিকাকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হওয়ার মতো ঘটনা। রহস্যময় সেই মেসেজটা আসার পর ঘটনাটা কি একই থাকল, নাকি বাঁক নিল অন্যদিকে? কে এই AK? কেনই বা সে এরকম একটা হুমকি ভরা বার্তা পাঠাল মৃত যুবকের মোবাইলে? তা হলে ঘটনাটা ঠিক কী ঘটল? দুঁদে পুলিশ কর্তা দেবাশিস ধরের প্রথমেই মনে হল তাহলে বিষয়টা কি অনেকটা ‘এক ফুল দো মালির’ চিত্রনাট্য? খুন এবং আত্মহত্যার পর যেটাকে কার্যত রুল আউট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক এসএমএসেই যেন কাহানি মে নয়া টুইস্ট। এবং হ্যাঁ। পুলিশ এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই শুরু করল তদন্ত। ৬ জানুয়ারি। ২০০৮। একটি খুন এবং আত্মহত্যার ঘটনায় তোলপাড় পড়ে গেল গোটা শান্তিনিকেতন জুড়ে। এর পাঁচ বছর আগে কবি গৃহ থেকে নোবেল প্রাইজ চুরি যাওয়ার ঘটনায় বেআব্রু হয়েছিল বিশ্বভারতীয় নিরাপত্তা। এ বার আর ছিঁচকে চুরি নয়, বারবেলায় রীতিমত গুলি চলল সঙ্গীত ভবনের হস্টেলের অন্দরে। তাও আবার ওয়েবলি স্কট ৯ এমএম পিস্তল থেকে। কিন্তু তদন্তকারীদের সাধারণ বুদ্ধি বলছে এই পিস্তল তো ব্যবহার করার কথা খোদ পুলিশ অফিসারদের! তা হলে এই গুলি চালনার ঘটনায় মৃত ২৯ বছরের অমরেশ কুণ্ডুর হাতে এই আগ্নেয়াস্ত্র এল কী করে? তদন্ত আরও এগোতে এগোতে জানা গেল অমরেশ আসলে কলকাতার টালিগঞ্জ থানার অতিরিক্ত ওসির পার্ট-টাইম চালক। থানার বাক্স থেকে এই পিস্তল চুরি করে নিয়ে সে চেপে বসেছিল সকালের গণদেবতা এক্সপ্রেসে। গন্তব্য ছিল কলকাতা থেকে ১৯০ কিলোমিটার দূরের আনন্দ সদন। সেখানকার হস্টেলেই থাকত সঙ্গীত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী শাশ্বতী পাল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ হস্টেলের অনেকেই দেখতে পান বাইরে ওই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন একজন যুবক। তার ঘন্টাখানেক বাদে হস্টেলের ঘর থেকে ভেসে আসে পর পর দুটি গুলির আওয়াজ। আবাসিকরা ছুটে ভেতরে গিয়ে দেখতে পান খাটের ওপর পড়ে রয়েছে শাশ্বতীর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। ঠিক নীচে দরজার পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে পড়ে রয়েছে গুলিবিদ্ধ অমরেশ কুণ্ডু। তারপর থেকে সেই ঘরে বিশ্বভারতীর কর্তা, পুলিশ, মিডিয়া আরও আরও ভিড়! আমি তখন একটি বাংলা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক। ঘটনাচক্রে আমি তখন ছিলাম আসানসোলে। ওখানে একটি খনিতে আগুন লাগার ঘটনা কভার করতে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। ফেরার পথে অফিসের ফোন পেয়ে সরাসরি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে হয়েছিল শান্তিনিকেতন। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঘটনাস্থল প্রায় ফাঁকা। ওখানে দেখা গেল জেলার পুলিশ সুপার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা এবং বোলপুরের এসডিপিও দেবাশিস ধর তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করছেন। খানিকটা দূরে দাঁড়ালেও আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম তাদের কথোপকথন। হতে পারে পুরনো চেনার জন্য আমাকে দেখেও দেবাশিস যতটা জোরে সম্ভব সব তথ্য জানানো শুরু করলেন পুলিশ সুপারকে। সেই ফাঁকে আমি শুনে নিলাম বিস্তারিত ঘটনা। সেখানেই জানা গেল ফোনে রহস্যময় এসএমএসের কথা। পরদিন থেকে জোরকদমে এগোল তদন্ত। আর তাতেই জানা গেল আসল ঘটনা। ছোটবেলা থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা শাশ্বতী এবং অমরেশের। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্নাতক পর্ব পেরিয়ে কলকাতায় এসে টালিগঞ্জ থানায় অস্থায়ী গাড়ি চালকের কাজ নিলেও দু’জনের যোগাযোগ ছিলই। কলেজের পাঠ শেষ করে সঙ্গীত নিয়ে পড়তে চলে আসে শাশ্বতী। পুলিশ জানতে পারে তাদের মধ্যে তিন বছরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দুই বাড়ির লোকেরা সেই সম্পর্কের কথাও জানতেন। যদিও শাশ্বতীর বাড়ির লোকেদের এটা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রবল আপত্তি ছিল। ঘটনার ঠিক তিন দিন আগে অমরেশদের বাড়িতে ফোন করে শাশ্বতী জানিয়ে দেয় সে এই বিয়েতে রাজি নয়। অমরেশের বিয়ে যেন অন্যত্র ঠিক করা হয়। সমস্যাও শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই। সম্পর্ক ভাঙার কথা জানতে পেরে অমরেশ বেশ কয়েকবার ফোন করলেও শাশ্বতী তার সঙ্গেও কথা বলতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত এসপার-ওসপার করতে প্রেমিকাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, ঘটনার দিন সকাল সকাল টালিগঞ্জ থানায় চলে আসে অমরেশ। থানায় নিয়মিত আসার সুবাদে তার জানা ছিল আগ্নেয়াস্ত্র রাখার বাক্সটিতে তালা লাগানো হয় না, ওটি অরক্ষিত অবস্থাতেই থাকে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় সে। আগের রাতে ডিউটি করে কনস্টেবল সুনীল মাঝি সকাল ছ’টায় বাড়ি যাওয়ার আগে ওই বাক্সে ৯এমএম পিস্তলটি রেখে দেন। ভুলে সেই বাক্সে তালা দেননি তিনি। থানার পুলিশ কর্মীদের ডিউটি বদলের সময় সুযোগ বুঝে ওই পিস্তল পকেটে নিয়ে অমরেশ উঠে পড়ে ট্রেনে। সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ অমরেশকে হস্টেলের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ শাশ্বতীর সঙ্গে কথাও বলতে দেখা যায়।এক সময় তর্ক শুরু হলে ছাত্রীটি হস্টেলে ফিরে আসে। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি ছিল না পুলিশের চালক। গেটে কোনও নিরাপত্তা-কর্মী না থাকায় অবাধে ওপরে উঠে যায় সে। সে দিন রবিবার হলেও বিশ্বভারতীতে ক্লাস চলার কারণে বেশির ভাগ ছাত্রী হস্টেলে নিজের ঘরে ছিল না। আবার হস্টেলের সুপারভাইজার নাফিসা আলি তখন অফিসেও ছিলেন না। প্রায় ফাঁকা সিঁড়ি দিয়ে অমরেশ উপরে উঠে যায়। সে সময় হাতে একটি জলের বোতল নিয়ে অন্য একটি ঘর থেকে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল শাশ্বতী। আচমকা অমরেশকে উপরে দেখতে পেয়ে সে হস্টেল পরিষ্কার করতে আসা সুইপার ফুচি বীরবংশীকে বলে ওই যুবককে যেন বলে দেওয়া হয় সে তার সঙ্গে আর দেখা করতে রাজি নয়। সেই নিষেধ শোনার মতো ধৈর্য ছিল না অমরেশ কুণ্ডুর। সে সোজা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। জানলার সামনে তখন দাঁড়িয়ে ছিল শাশ্বতী। প্রথমে তার বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তারপরের গুলিটা নিজের মাথাতে। খুন এবং আত্মহত্যার ঘটনার পর পুলিশ দুটি মৃতদেহই ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়। ‘ওপেন অ্যান্ড শাট’ এই কেসে বীরভূম পুলিশের তদন্তে এখানেই কার্যত দাঁড়ি পড়ে যাওয়ার কথা। তা আর হল কোথায়? অমরেশের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় মোবাইলে যে হুমকি এসএমএসটি ঢোকে পুলিশের তদন্তের অভিমুখ ঘুরে যায় এবার সেদিকে। পুলিশের ছানবিনে উঠে আসে, অমরেশের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার আগেই শাশ্বতীর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত যুবক অঞ্জন কারকের সঙ্গে। হবু স্ত্রী অঞ্জনকে জানায় পূর্ব প্রেমিকের কথা। এও জানায়, পুরনো সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চাইলেও অমরেশ তাতে রাজি হচ্ছে না। নিজেকে পুলিশকর্মী পরিচয় দিয়ে নানা ভাবে হুমকি দিচ্ছে সে। শাশ্বতীর পাশে দাঁড়াতে এরপর অমরেশকে হুমকি দিয়ে এসএমএস পাঠানো শুরু করে অঞ্জন। পুলিশের জেরার জবাবে জানায়, যে আশঙ্কা থেকে সে পাল্টা হুমকি বার্তা পাঠিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা ঘটেই গিয়েছে। এই একটি স্বীকারোক্তিতে পুলিশের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল মেসেজে উল্লেখ করা AK আসলে কে। সেই সঙ্গে চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই মামলার ফাইল।